ইচ্ছের ঘোড়ার লাগামটা যদি শক্ত হাতে ধরা থাকে তাহলে পৃথিবীর সবকিছুই যে অবাক করা সহজ তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। ছোট্ট তেহজিব তেমনি একজন। ইচ্ছের ঘোড়া ছুটিয়ে চলতে থাকা ৫ বছর ৪ মাস বয়সী ছোট্ট তেহজিবের তাজিনডং জয় একটি নিছক ঘটনা মাত্র নয়! এ এক অফুরাণ প্রাণ শক্তির অঙ্কুরোদগম কিংবা অসম্ভের ভীড়ে সকল সম্ভাবনার প্রবল অনুপ্রেরণা। সেই অনুপ্রেরণার ভীড়ে হারাতে চাইলে পড়তে থাকুন ছোট্ট তেহজিবের তাজিনডং জয়!
প্রত্যেকবারের ন্যায় এবারো অপেক্ষা করছিলাম হিট দ্যা ট্রেইল পরিবারের ঢাকা থেকে আসা বান্দরবানগামী বাসের জন্য। অপেক্ষার প্রহর শেষে অবশেষে বাস আসলো ৪:৩০ মিনিটে। সঙ্গে থাকা দুজনকে নিয়ে উঠে পড়লাম বাসে। বরাবরের মত দু-চার জন ছাড়া সবাই ঘুম। আনুমানিক ৬:৩০ মিনিট নাগাদ বান্দরবান পৌঁছালাম। সবাই বাস থেকে নামছে হঠাৎ দেখলাম আনুমানিক ৫- ৬ বছর বয়সের এক পিচ্চিও বাস থেকে নামলো। দেখে শুধু অবাকই হলাম না চিন্তিত হয়ে পড়লাম। বাচ্চার মা বাবাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে চেয়েও চাদের গাড়ি চলে আসাতে বাকি টিম মেম্বারদের খোঁজ নিতে নিতে আর জিজ্ঞেস করা হলো না। ভাবলাম একে কোলে করে নিয়েই অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। থানচি পৌঁছে নানাবিধ প্রস্তুতির মাঝেই পিচ্চির সাথে কথা বললাম:
আমিঃ কেমন আছো??
উত্তরঃ ভালো।
আমিঃ নাম কি তোমার??
উত্তরঃ তেহজিব
ঢাকা থেকে বান্দরবান, বান্দরবান থেকে থানচি এতো রাস্তা পাড়ি দেবার পরও তার চোখে মুখে ক্লান্তি দেখিনি। যদিও পুরোটা পথ গাড়িতেই এসেছি তাই বিষয়টা খুব স্বাভাবিক বলেই মনে হচ্ছিলো। কিন্তু তখনো জানতাম না আমি ভুল। আমার চিন্তা ভাবনাও ভুল। কথাই আছে না “Don’t judge a book by its cover”। যাই হোক খুব বেশি সময় নেয় নি সে আমাকে ভুল প্রমাণিত করার জন্য। খুব সুন্দরভাবেই শুরু করলো হাঁটা। পিছনে তেহজিব এর বাবা-মাও রয়েছে। কিছু দূর হাঁটছে আবার ঘুরে ঘুরে দেখছে পিছনে তার বাবা-মা ঠিক আছে কি না। ঘন্টা দেড়েক পরও খেয়াল করে দেখলাম শুরুতে যেইভাবে হাঁটছিলো ঠিক একই গতিতে হেঁটে চলেছে তেহজিব। আমরা সবাই অবাক। অনেকেই যখন হাঁটতে পারছিল না কিংবা হাল ছেড়ে দেওয়ার মত অবস্থা তখন তেহজিবই হয়ে উঠলো তাদের একমাত্র অনুপ্রেরণা।
তেহজিব এর সাথে, ওর পাশে পাশেই হাঁটছিলাম আমি। কিছু কিছু জায়গায় অনেক রিস্ক ছিলো, পিচ্ছিল ছিলো তাই সাহায্য করার কথা ভেবে তেহজিব এর হাত ধরতে চাইলাম। কিন্তু চেহারা দেখেই বুজলাম সে খুব বিরক্ত। যাকে কি না কোলে করে নিয়ে ট্রেকিং করতে হবে চিন্তা করে ছিলাম সে হাত ধরাতেই বিরক্ত।
আমিঃ SHOCKZ!!!
তেহজিবঃ ROCKZ!!!
তেহজিব কে দেখতে দেখতেই নেত্রীর পিছু পিছু একসময় শেরকর পাড়ায় পৌঁছে গেলাম সবাই। ততক্ষণে আমার বোঝা হয়ে গেছে আমি কতখানি ভুল ছিলাম। পাড়ায় পৌঁছে সবাই তেহজিবকে নিয়ে ছবি তুলা শুরু করলাম। সন্ধ্যা গড়িয়ে এলো সবাই যার যার মত বিশ্রাম নিয়ে কিছুক্ষন আড্ডা দিয়ে রাতের খাবার খেতে বসলাম। রাতের খাবার সেরে আবার চায়ের দোকানে আড্ডা। পরের দিন সকাল সকাল উঠতে হবে তাজিংডং সামিট করার জন্য তাই কেউ কেউ ঘুমিয়ে পড়েছে এরই মাঝে।
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়লাম তেহজিবও ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। জিজ্ঞেস করলাম আম্মু আজ আবার পাহাড়ে উঠতে হবে কিন্তু! যেন কোন ব্যাপারই না এমন একটা ভাব নিয়ে সে জানালো হ্যাঁ উঠবো!পাহাড়ে যাবো! অবাক হইনি কারণ আশা করি বলতে হবে না। সবাই মিলে কিছুক্ষণ ছবি তুলে শুরু করলাম হাঁটা। খাড়া পাহাড় উঠতে উঠতে বিশ্রামের ফাঁকে ফাঁকে কেউ কেউ তেহজিব এর সাথে ছবিও তুলছে।তেহজিব একদম বিরক্ত হচ্ছিল না। তেহজিব তখনই বিরক্ত হয় যখন কেউ তার ধরে হাঁটতে চায়। বিশ্রাম শেষে আবারও হাঁটা শুরু। তেহজিব যখন পাহাড়ি পথে উঠতে উঠতে ঘেমে যাচ্ছিলো আর তার সাথে থাকা গামছা দিয়ে মুখ মুছতে ছিলো বিশ্বাস করুন তখনও তার মুখে হাসি। একটু ক্লান্তির ছাপ নেই সেই মুখে। আহা কত যে সুন্দর দৃশ্যটা এখনো চোখে ভাসে আমার!
সেদিন অনেক অনেক গরম ছিলো। ঘন্টাখানেক পর অনেকেই জিজ্ঞেস করছিলো আর কতক্ষণ লাগবে?? কিন্তু তেহজিব একবারও জিজ্ঞেস করেনি সে তার মত হেঁটেই চলেছে আবার গল্প করছে। আবার দলের অনেকের খেয়ালও রাখছে কে কোথায়? তাজিংডং এর কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম। তাজিংডং উঠার সময় একদম খাঁড়া একটি পথ বাঁশের সাহায্য উঠতে হয় যা দেখে অনেকেই ভয় পেয়েছিলো। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে, সেই জায়গাটিও তেহজিব উঠে গেছে যা অনেক রিস্কি ছিলো। অবশেষে তেহজিব উঠে গেলো তাজিংডং এর চূড়ায়। আমরা সবাই তেহজিবকে হাত তালি দিয়ে অভিনন্দন জানাই। তারপর আধঘন্টা ধরে তেহজিবকে নিয়ে ছবি তোলা চললো সবার। কেউ সিঙ্গেল, কেউ ডাবল আর তেহজিব হাসিমুখে আমাদের এই অত্যাচার সহ্য করে যাচ্ছিল। ছবি তোলা শেষে সবাই কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার শেরকর পাড়ার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। প্রচন্ড রোদ মাথায় নিয়ে চলে আসলাম শেরকর পাড়া।
বিকেলে শেরকর পাড়ার চায়ের দোকানে জমজমাট গানের আসরে মেতে উঠেছি সবাই। কে গান শুনাবে, কে গান শুনাবে এমন মুহুর্তে তেহজিব গান গেয়ে উঠলো। সবাই অবাক হয়ে গেলাম ওর গানের গলা শুনে। বকুল ফুল, কফি হাউস সহ চারটি গান শুনিয়েছে। অনেক সুন্দর করে পুরো গান গেয়ে, আমাদের আড্ডা জমিয়ে দিয়েছে তেহজিব। তেহজিব এর গান শুনতে শুনতে সন্ধ্যা নেমে এলো। সবাই রুমে গিয়ে বিশ্রাম নিয়ে আবারো আড্ডা শুরু করলাম। তারপর খাওয়া দাওয়া করে ঘুম কারণ, এর পরের দিন সকাল ৪ টায় ঘুম থেকে উঠে হাঁটা শুরু করতে হবে। গন্তব্য থানচি। সবাই সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে গেলাম। তেহজিব তখনও ঘুম। কিছুক্ষণ পর তেহজিবকে ঘুম থেকে ডেকে উঠানো হলো। বুঝতে পারলাম গতরাতে ভাল ঘুম হয়নি বাচ্চাটার।
সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে ভোর পাঁচটায় হাটা শুরু করলাম সবাই। সকাল সকাল রওনা দেওয়াতে কষ্টটাও তুলনামূলক কম হয়েছে। বোর্ডিং পাড়া হয়ে চলে আসলাম থানচি। সেখানে দুপুরের খাবার সেরে চাদের গাড়ি করে তেহজিবের সাথে সবাই গান করতে করতে চলে আসলাম বান্দরবান শহরে। যেহেতু বৈসাবি উৎসব চলছিল তাই আমাদেরকে পানি মারা হয়েছিলো রাস্তায়। তেহজিব উপভোগ করেছে পানি খেলা।
তেহজিব এর আগে কেওক্রাডং জয় করেছে।
ঘুরেছে ৬৪ জেলা।
তেহজিব একটি অনুপ্রেরণার নাম। সবাই তেহজিবের জন্য দোয়া করবেন যেন এমনি করে সবকিছু জয় করে ফিরতে পারে ছোট্ট এই মানুষটা!
পরিশেষে একটাই কথা তা হল, তেহজিব পেরেছে তাই এক্ষুনি আপনার আদরের বাচ্চাটিও পারবে তা কিন্তু নয়। হ্যাঁ পারবে একদিন। হুট করে নয়! পাহাড়ের মাঝে নিজেকে সামলানোই অনেক কষ্ট। তাই নিজের প্রতি ও বাচ্চার প্রতি শতভাগ নিশ্চিত হয়েই পাহাড়ে যাবেন। তার আগে ছোটখাটো পাহাড় পাড়ি দিয়ে আসুন বাচ্চাকে নিয়ে।
লেখা ও ছবিঃ Md Nur Uddin Rasel
GET SOCIAL
Subscribe and stay up to date.
ATTENTION!
নিজস্ব জগতে প্রতিনিয়ত নিজের পায়ে ভর করে দাঁড়াতে চাওয়া নারীদের আনন্দ, হাসি, ভাবনা, বিশ্লেষণ কিংবা জয়-পরাজয়ের গল্পগুলোকে একত্রে জড়ো করে রাখার ক্ষুদ্র প্রয়াস “নারীদের গল্প” বিভাগটি। আর গল্পগুলোর লেখক কিংবা পাঠক, আপনারাই।
আপনার লেখা আমাদের কাছে পাঠাতে আমাদের Contact পেইজে যোগাযোগ করুন অথবা ইমেইল করুন [email protected] এই ঠিকানায়।
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
|Discussion
BEST SARRES|
READ MORE|